
দেশের সেবা খাতগুলোর মধ্যে অন্যতম স্বাস্থ্য খাতের অস্বাস্থ্যকর চিত্র একের পর এক উন্মোচিত হয়ে চলেছে। সর্বশেষ ৩০ নভেম্বর সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবর, সচিবালয়ে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে কেনাকাটা-সংক্রান্ত ১৭টি নথি গায়েব হয়ে গেছে! দেশের সুরক্ষিত স্থানগুলোর মধ্যে সচিবালয় অন্যতম। কিন্তু এই সুরক্ষিত স্থান কতটা অরক্ষিত তা-ই প্রতিভাত হলো বিস্ময়কর এই ঘটনার মধ্য দিয়ে। একই সঙ্গে এ প্রশ্ন দাঁড়ালো- স্বাস্থ্য মন্ত্রণলায়ের এই বিভাগের দায়িত্বশীলরা কি এতটাই দায়িত্বহীন যে, নিজেদের নথি আগলে রাখার সক্ষমতাও রাখেন না!
একটি মন্ত্রণালয়ের কেনাকাটা-সংক্রান্ত নথি গায়েব কি শুধু চুনোপুঁটিদের দ্বারা সম্ভব যদি ওপরের স্তরের অসাধুদের যোগসাজশ না থাকে? আমরা জানি, অনেক ক্ষেত্রেই সরকারি কেনাকাটা মানেই অসাধুদের যথেচ্ছ কর্মকাণ্ডের বিষয়। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ওই বিভাগ থেকে কেনাকাটা-সংক্রান্ত যে নথিগুলো গায়েব হয়ে গেল সেগুলোতে কি বড় ধরনের কোনো অনিয়ম-দুর্নীতি কিংবা কেলেঙ্কারির ছাপ ছিল? গায়েব হওয়া ১৭টি নথির মধ্যে বিভিন্ন মেডিকেল কলেজ ও বিভাগের কেনাকাটা সম্পর্কিত নথি ছাড়াও নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদপ্তর, স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের একাধিক প্রকল্পের নথিও গায়েব হয়েছে- সংবাদমাধ্যমে এও বলা হয়েছে।
রাজধানীর শাহবাগ থানায় এ ব্যাপারে যে সাধারণ ডায়েরি করা হয়েছে, সেখানে ওই ১৭ নথির কথাই শুধু উল্লেখ করা হয়েছে। ওই ঘটনার পর গঠিত হয়েছে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি- যার নেতৃত্বে রয়েছেন একজন অতিরিক্ত সচিব। সমকালের প্রতিবেদনে দেখলাম, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের একজন অতিরিক্ত সচিব বলেছেন, ওই ১৭টি নথি সম্পর্কে তারও কোনো ধারণা নেই! কী বিস্ময়কর! এতবড় একজন কর্মকর্তা মন্ত্রণালয় বা বিভাগের গায়েব হওয়া নথিগুলো সম্পর্কে তার 'ধারণা নেই' এমন কথা বলে শুধু অদক্ষতার পরিচয়ই দেননি, তার এই মন্তব্য আরও কিছু প্রশ্নও দাঁড় করিয়েছে। মাসখানেক আগে সংবাদমাধ্যমেই দেখেছিলাম, এই মন্ত্রণালয়ের কেনাকাটা-সংক্রান্ত আরেকটি নথি গায়েব হয়েছিল। ওই ঘটনার শেষ পরিণতি জানি না। পরিতাপের সঙ্গে বলতে হয়, দেশের স্বাস্থ্য খাত ঘিরে অনিয়ম-দুর্নীতি-স্বেচ্ছাচারিতার যেসব নগ্ন চিত্র ইতোমধ্যে দেখা গেছে, এতদিন পরও এর তো কোনো উন্নতি হয়নি।
স্বাস্থ্য খাতের অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে এত কথা হলেও, সরকারের নীতিনির্ধারকদের কঠোর অবস্থানের ঘোষণা সত্ত্বেও দুর্নীতিবাজরা এসব কোনো কিছুই আমলে নেয়নি, আমলে রাখেনি। স্বাস্থ্য খাতের দেখা নগ্ন চিত্রের বাইরেও এখনও না জানি আরও কত কদাচারই রয়ে গেছে অদেখা। গত বছর যখন করোনা-দুর্যোগে দেশের অবস্থা খুব নাজুক ছিল, তখন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) একটি অনুসন্ধানী দল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরসহ কেন্দ্রীয় ঔষধাগারে কিছু অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে চালিয়ে ছিল অভিযান। এর আগের বছর দুদকই কেনাকাটাসহ বদলি, পদায়ন, ওষুধ সরবরাহ ইত্যাদি ১১টি খাত অধিক দুর্নীতিগ্রস্ত বলে চিহ্নিত করেছিল। এই কলামেই লিখেছিলাম, স্বাস্থ্য খাতে যে অশুভ শক্তির ছায়া পড়েছে, তা দূর করতে হলে এর খোলনলচে পাল্টে ফেলতে হবে। অভিযুক্ত ব্যক্তিবিশেষের পদত্যাগ কিংবা এক জায়গা থেকে সরিয়ে শুধু অন্য জায়গায় বসালেই এই খাতে সৃষ্ট ক্ষত উপশম সম্ভব নয়।
বস্তুত তা-ই দেখা যাচ্ছে। পুরো ব্যবস্থা ঢেলে না সাজিয়ে, ক্ষত উপশমের মোক্ষম দাওয়াই না দিয়ে প্রলেপ দিয়ে ক্ষত সারানোর চেষ্টা কার্যত কোনো সুফল বয়ে আনতে পারেনি এবং স্বাস্থ্য খাত এর খণ্ডিত দৃষ্টান্ত মাত্র। যদি জবাবদিহি, সুশাসন সত্যিকার অর্থেই প্রতিষ্ঠিত করতে হয় তাহলে 'টোটকা দাওয়াই' কোনোই যে কাজ দেবে না, তাও ফের দেখা গেল স্বাস্থ্য খাতে। স্বাস্থ্য খাতের ব্যাধি এত গভীর হয়ে পড়েছে, এর জন্য দরকার যথাযথ চিকিৎসা। দেশের চিকিৎসাসেবা ব্যবস্থা নিয়ে রয়েছে অন্তহীন নেতিবাচক প্রশ্ন। করোনাকালে জরুরি স্বাস্থ্য উপকরণ, চিকিৎসা সামগ্রীসহ করোনার পরীক্ষার ক্ষেত্রে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে ঘটেছে অনেক তুঘলকি কাণ্ড। আজ পর্যন্ত কয়টি ঘটনার দৃষ্টান্তযোগ্য প্রতিকার হয়েছে? অভিযুক্ত কাউকে কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বটে এবং পদত্যাগ করতে হয়েছে কিংবা মামলাও হয়েছে কিন্তু এরপরও সুফল কেন মেলেনি- এ প্রশ্নের উত্তর তো জটিল কিছু নয়।
দূর অতীতের কথা না হয় বাদই দিলাম, কিন্তু গত দেড় বছরেরও বেশি সময়ে এই খাতে যেসব অনিয়ম-দুর্নীতি-লুটপাট হয়েছে এসবের দ্রুত দৃষ্টান্তযোগ্য প্রতিকারই দেশের সচেতন মানুষ আশা করেছিল। আরও দাবি ছিল, স্বাস্থ্য খাতের অনিয়ম-দুর্নীতির উৎস অনুসন্ধানে এই মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের সঙ্গে সম্পর্কহীন সম্পূর্ণ স্বাধীন-নিরপেক্ষ তদন্ত কমিটি গঠন করে সব অভিযোগ খতিয়ে দেখে প্রতিকার নিশ্চিত করা হোক। আমাদের স্মরণে আছে, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআইবি) নিকট অতীতে 'করোনাভাইরাস সংকট মোকাবিলা :কভিড-১৯ টিকা ব্যবস্থাপনা সুশাসনের চ্যালেঞ্জ' শীর্ষক গবেষণায় স্বাস্থ্য খাতের নানা অনিয়ম ও দুর্নীতি উঠে এসেছিল। সেসব আমলে নিয়ে যদি সরকার নির্মোহ অবস্থান গ্রহণ করে প্রতিকারে নিষ্ঠ হতো, তাহলে হয়তো ক্ষত এত বিস্তৃত হয়ে পড়ত না।
কথায় আছে, 'সর্বাঙ্গে ব্যথা ওষুধ দেব কোথা'। স্বাস্থ্য খাত যেন তেমনই একটি খাত। অনেকেরই হয়তো মনে আছে, গত বছর জাতীয় সংসদে সরকারি, বিরোধী ও সরকারি দলের শরিক দলগুলোর সদস্যরাও স্বাস্থ্য খাতের অনিয়ম-দুর্নীতি ও অদক্ষতার কঠোর সমালোচনা করেছিলেন। রাষ্ট্রশক্তির তরফে প্রতিকারের ক্ষেত্রে এরও কোনো প্রতিফলন দেখা গেল না। মনে রাখা উচিত, উটপাখির মতো বালুতে মুখ গুঁজে থাকলে অনিয়ম-দুর্নীতির নগ্নরূপ ঢেকে রাখা যাবে না।
শুধু স্বাস্থ্য খাতে কেন যে কোনো খাতেই দুর্নীতি যাতে না হয়, সেই রকম ব্যবস্থা নিতে হবে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের 'শূন্য সহিষ্ণুতা'র অঙ্গীকার সত্ত্বেও নানা খাতে অনিয়ম-দুর্নীতি চলছেই। দুর্নীতিবাজদের লাজলজ্জা তো নেই-ই; নূ্যনতম ভয়-ভীতিও নেই! আমাদের এখানে বিচারহীনতার অপসংস্কৃতি নিয়েও এ পর্যন্ত কম কথা হয়নি। তাছাড়া আইনের শাসন, ন্যায়বিচার, দ্রুত বিচারের ক্ষেত্রে বিলম্ব ইত্যাদি নানা কারণে দুর্নীতিবাজরা কাউকেই যেন তোয়াক্কা করে না। তাছাড়া তাদের সামনে তো দৃষ্টান্তযোগ্য দৃষ্টান্ত দাঁড় করানো যাচ্ছে না। এমতাবস্থায় আমরা যতই চিৎকার করি না কেন- দুর্নীতির মূলোৎপাটন করতে হবে কিন্তু এর সুফল মিলবে কী করে? অব্যবস্থা জিইয়ে রেখে কোনো শুভ প্রত্যাশা করা দুরাশারই নামান্তর। সাধারণ মানুষের কল্যাণ ও সেবার নামে বিশেষ করে করোনাকালে স্বাস্থ্য খাতে লুটপাট ও দুর্নীতির যে রাজত্ব কায়েম হয়েছে, এর শিকড় উৎপাটন করতে হলে চুনোপুঁটিদের শুধু ধরলেই চলবে না, রাঘববোয়ালদের কঠোর আইনের আওতায় আনতে হবে। অনিয়ম-দুর্নীতিতে নিমজ্জিত ভঙ্গুর স্বাস্থ্য খাতের আর কত কদর্যতা দেখতে হবে?
প্রশ্ন আছে অনেক কিন্তু উত্তর দেওয়ার দায় যাদের, অনিয়মের প্রতিকার কিংবা প্রতিবিধানের দায়িত্ব যাদের, তাদের অবস্থান যদি নির্মোহ হয় এবং আইন যদি তার নিজস্ব ও স্বাভাবিক গতিতে চলতে পারে তাহলে যে কোনো সমাজেই অনিয়ম-দুর্নীতির পথ রূদ্ধ হতে বাধ্য। দুর্নীতি নির্মূলে সর্বাগ্রে দরকার রাজনৈতিক অঙ্গীকার। এই অঙ্গীকার আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর নীতিনির্ধারকদের আছে বটে কিন্তু তা যেন শুধু উচ্চারণসর্বস্ব- বিদ্যমান বাস্তবতা তো এ সাক্ষ্যই বহন করে। এর পরিণাম আরও ভয়াবহ হয়ে দাঁড়াতে পারে, যা সৎ বোধসম্পন্ন কারোরই কাম্য নয়।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা
মন্তব্য করুন