যারা মরতে রাজি, তাদের পরাজিত করা যায় না

ফারুক ওয়াসিফ
ফারুক ওয়াসিফ
প্রকাশ: ২৪ জুলাই ২০২৪ | ০২:১৪
এমন দৃশ্য কে কবে দেখেছে। ওরা মৃত্যুকে ভয় পায় না। যারা অন্যায়ের কাছে মাথা নত করবার চাইতে আত্মদানই বেছে নেয়, তাদের কেউ কোনোদিন পরাজিত করতে পারে না। দলের হলে বোঝানো যেত, কিন্তু ৫৫ ভাগ তরুণের বাংলাদেশ যখন এক প্রতিবাদী সুতায় গাঁথা হয়ে গেছে, দেশের প্রতিটি পরিবার যখন আবেগ আর ক্রোধে জ্বলছে, তখন দয়া করে থামুন। হুঁশে ফিরুন মাননীয় কর্তৃপক্ষ।
৭ শহীদের কবরের মাটি এখনও কাঁচা। রাজপথে রক্তের দাগ এখনও মোছেনি। তারপরও, তারপরও নির্দয় হাতে অন্তত আরও ১৯টি প্রাণ কেড়ে নেওয়া হলো! একটি অপমৃত্যু পারিবারিক ট্র্যাজেডি। কিন্তু অনেক মৃত্যু কি পরিসংখ্যান? নাকি তা জাতীয় বিপর্যয়, নাকি দেশটাই আজ কারবালা। শুনুন সেই নদীমাতৃক কারবালার দেশের শহীদদের কিছু নাম: সাঈদ, রাফি, ওয়াসিম, ফারুক, ফারহান, মুগ্ধ, তানভীর, তাহমিদ…এরকম ১৯টি নাম কি শুধুই কিছু অক্ষর? না, তারা অক্ষর না, তারা আমাদের অন্ধকার আকাশের একেকটি নক্ষত্র। জীবিত থাকতে দেশকে মানবিক করবার জন্য লড়েছে, শহীদ হয়ে এখনও পথ দেখিয়ে চলছে। তারা মৃত নয়, তারা আমাদের চেয়েও বেশি জীবন্ত। একাত্তরের শহীদদের মতো তারাও আমাদের ইতিহাসে অমর হয়ে থাকুক। এই দূষিত ও লুণ্ঠিত জমিন তাদের উপযুক্ত জায়গা না, তাদের উপযুক্ত জায়গা মানুষের হৃদয়। তাই আমাদের বুকের মধ্যে খোঁড়া হচ্ছে তাদের কবর। আমাদের হৃদয়কে কে যেন গোলমরিচের মতো পিষে দিয়ে যাচ্ছে। তবু ওদের কবরগুলি আমরা সেই হৃদয়েই রাখতে চাই। বুকে করে বহন করতে চাই। কারণ, এই লাশের ভার আমরা কাঁধ দিয়ে বইতে অক্ষম।
কাঠের ব্যবসায়ীর প্রাণবন্ত গাছের দরকার নাই, তার দরকার মরা গাছের কাঠ। ডোমের দরকার মৃত প্রাণীর চামড়া। কিন্তু আমার জানা নাই, কার এত তরুণ প্রাণের রক্ত দরকার, দেশের সেরা সন্তানদের লাশ দরকার! সরকার তো এই মাটিতে মানুষের জীবনমৃত্যুর ম্যানেজার। সেই ম্যানেজারেরা কি হিসাব কষে দেখবেন মৃত্যুর টালিখাতায় কত নাম জমা পড়লো?
শুরুতে বিষয়টা ছিল রাষ্ট্রীয় অধিকারের মধ্যে বৈষম্য দূর করার দাবি। রাষ্ট্রীয় সম্পদের মতো রাষ্ট্রের চাকরিরও সমবণ্টন দরকার। তা ছাড়া মানবিক সমাজ হয় না। দেশের তরুণ মানবসম্পদকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া দরকার, তা ছাড়া কোনো জাতি এগোয় না। কিন্তু আমরা তরুণবিরোধী এক সিস্টেম বানিয়েছি। তরুণেরা চেয়েছে এই সিস্টেমের সংস্কার–কিশোর আন্দোলনের রাষ্ট্র মেরামতের দাবি তাই কোটা সংস্কার আন্দোলনের আওয়াজের মধ্যে শোনা গেছে। তারা চেয়েছে ন্যায্যতা, সমতা আর মর্যাদা। বাংলাদেশের মানুষ পেটের মার সয়, কিন্তু অপমান সয় না। কিন্তু বারবার তারা অপমানিত হয়েছে, নিজ দেশে তারা পরাধীন বোধ করেছে।
সমবণ্টন ও সমমর্যাদা পাকিস্তান রাষ্ট্র দিতে চায়নি বলেই তো আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছি। কিন্তু সেই মুক্তিযুদ্ধের ফসল যে রাষ্ট্র, সেটা কেন পাকিস্তানি বৈষম্যমূলক কায়দায় চলবে–এই প্রশ্ন করাই তো মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা দাবির মধ্যে কী ছিল? ছিল সামরিক-বেসামরিক চাকরি এবং জাতীয় আয়ের ন্যায্য ভাগের দাবি। ভাষা আন্দোলন কি নিছক সাংস্কৃতিক আন্দোলন ছিল? তা ছিল বাংলা ভাষায় রাষ্ট্রকাজ, শিক্ষা ও চাকরি করার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক আকাঙ্ক্ষার প্রকাশ। তাই কোটা সংস্কারের দাবিকে স্বার্থপর দাবি যারা বলেন, তারা ইতিহাসও বোঝেন না, সমাজও বোঝেন না। মানুষের প্রতি তাদের কোনো দরদ বা দায়িত্ববোধ আছে কিনা, সন্দেহ।
এরকম অবস্থায় ‘মুখে শেখ ফরিদ বগলে ইট’ কায়দায় মুক্তিযুদ্ধের স্লোগানের আড়ালে রাষ্ট্রটাকে পাকিস্তানি মডেলে নিয়ে যাওয়া বসে বসে দেখবে তরুণ প্রজন্ম?
কারা এই তরুণ প্রজন্ম? এরা গণতন্ত্র দেখেনি, ভোটাধিকার দেখেনি। এরা দেখেছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার জয়জয়কার, দেখেছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, দেখেছে জয়বাংলা কনসার্ট, পাঠ্যপুস্তকে পড়েছে মুক্তিযুদ্ধের ‘সঠিক’ ইতিহাস। তারপরও কেন তাদের ‘রাজাকারের নাতিপুতির’ তকমা বইতে হবে? তারা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের প্রতি, অবর্ণনীয় ত্যাগের প্রতি নত হয়েছে। তারপর মাথা তুলে দেখেছে, বাস্তবতা ভিন্ন। দেশ চলছে উল্টোপথে। এখানেই ইতিহাস আর বর্তমান তাদের চোখে আলাদা হয়ে গেছে। তারা ধোঁকা খেয়েছে। তাদের মন বিষিয়ে গিয়েছে।
তাই কোটা সংস্কারের দাবিকে অস্ত্রের জোরে দমন করার চেষ্টা হলে তারা ফুঁসে উঠেছে রংপুরের বীর শহীদ ছাত্র আবু সাঈদের মায়ের মতো। সোনার টুকরা এই মেধাবী ও সংগ্রামী ছেলের লাশ কোলে নিয়ে তিনি মাতম করেছেন, ‘হামার ছাওয়াক তুই চাকরি দিবু না, না দিবু, কিন্তু মারলি ক্যানে?’ রাস্তায় ছেলেমেয়েদের মধ্যেও দেখেছি একই ক্ষোভ। তারা প্রকাশ্য ক্যাম্পাসে, রাতের অন্ধকারে হলের ভেতর বড় ভাই ও বোনদের ওপর নৃশংস নির্যাতন দেখে নেমে এসেছে পথে। মনের ভেতর একই কথা, ‘কেন মারল তারা?’
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের মেধাবী ছাত্র আবু সাঈদের টানটান করা বুকে পুলিশের উপর্যুপরি গুলির দৃশ্যও তারা দেখে ফেলেছে। এ ঘটনা অবিশ্বাস্য, অলৌকিক, অভূতপূর্ব। ন্যায়ের দাবিতে এভাবে দুই হাত দুই দিকে আত্মসমর্পণের ভঙ্গিতে ছড়িয়ে দিয়ে সাঈদ যেন জানাতে চেয়েছে, আমি নিরস্ত্র, আমি নির্ভীক, তোমরা যদি আমার বুকে গুলি করতে চাও তো করো; কিন্তু দাবি আমি জানিয়েই যাব। এই সরল সাহসের ভঙ্গিমা সহ্য হয়নি। তাই তাঁকে হত্যা করা হয়েছে।
তারপর, একে একে ১৯টি প্রাণ ঝরে গেল। এর মধ্যে গরিব ছাত্ররা আছে, ধনী ও উচ্চবিত্ত ঘরের ছাত্রছাত্রীরাও আছে। আছে দিনমজুর, রিকশাচালক, সবজি বিক্রেতা। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের এক অধ্যাপকও ছাত্রছাত্রীদের বাঁচাতে এসে রাবার বুলেটে ক্ষতবিক্ষত হয়েছেন। নিহত ও আহতের সারির দিকে তাকিয়ে দেখুন, এরাই সত্যিকারের বাংলাদেশ। বাংলাদেশের সব শ্রেণি-পেশা ও এলাকার মানুষ এখন এক তরঙ্গে থরথর প্রতিবাদে শামিল। এটাই আমাদের জাতীয় সমাজ। সেই সমাজের বুকেই বন্দুক তাক করা হয়েছে। এই সমাজটাকেই যেন অন্ধ আক্রোশে হত্যা করা হচ্ছে।
তরুণ সমাজ তাই আর কর্তৃপক্ষকে বিশ্বাস করতে পারছে না। আপনারা সময় থাকতে আলোচনা করলেন না, বরং চূড়ান্ত টিটকারি করলেন। এমনকি সাতটি তরতাজা প্রাণ ঝরে যাবার পরেও থামলেন না। মধ্যরাতে ক্যাম্পাসগুলি খালি করতে বাহিনী পাঠালেন। তারপরও আরও ১৯টি প্রাণ গেল। দেশের কোটি কোটি মানুষ ভয়ার্ত দিন আর নির্ঘুম রাত পার করছে।
এই সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে চেয়েছে, তরুণবান্ধব উন্নয়ন করতে চেয়েছে। কিন্তু কার্যত দেখা গেল, তরুণেরাই সবচেয়ে আক্রান্ত এই দেশে। শিক্ষাব্যবস্থায় চরম নৈরাজ্য, চাকরির বাজারে মঙ্গা, আশি ভাগ তরুণই দেশে ভবিষ্যৎ দেখে না। এই কিশোর-কিশোরীরাই নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে দমনপীড়নের শিকার হয়েছে। সেখান থেকে পোড় খেয়ে উচ্চশিক্ষায় এসেছে। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেও তারা দেখেছে, সেখানেও ছাত্রলীগ নামধারীদের জুলুম। তারা যেন তৃতীয় শ্রেণির নাগরিক আর ছাত্রলীগ করনেওয়ালারা আইনের ঊর্ধ্বে থাকা একেকজন মধ্যযুগীয় রাজপুত্র। শিক্ষার্থীরা ঘুমায় গণরুমে গাদাগাদি করে, আর ছাত্রনেতারা বছরের পর বছর হলের রুম দখল করে রংমহলের আলিশান জীবন যাপন করেন। এভাবে বারবার বঞ্চনা, উপেক্ষা আর নির্যাতনের শিকার হয়ে আবার তারা মাঠে নেমেছে। ২০১৮ সাল থেকে এ পর্যন্ত তরুণদের কোনো দাবিদাওয়াকে যৌক্তিক কায়দায় নিরসন করা হয়েছে? কোনবার তারা মার খায়নি? শিবির বা রাজাকার বলে তাদের দমানো যাবে না। রাজপথে যারা মুক্তিযুদ্ধের পতাকা হাতে লড়ছে, শহীদ হলে লাল-সবুজে ঢেকে দিচ্ছে লাশ, তারাই আজকের মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযোদ্ধারা কখনো রাষ্ট্রীয় মদদে সাঁজোয়া যান আর বন্দুক হাতে স্বজাতির ওপর হামলে পড়ে না।
কিন্তু মধ্যরাতে ক্যাম্পাস খালি করা, ২৬ জনের বেশি আন্দোলনকারীকে হত্যা করা মনে করিয়ে দিচ্ছে পাকিস্তানি বাহিনীর বিশ্ববিদ্যালয় খালি করার আগ্রাসনের কথা। মুক্তিযুদ্ধের ৫৩ বছর পর এটা কোনোভাবে মানা যায়? এই দেশে জীবন কি ক্ষমতার তুলনায় এতই সস্তা?
রাষ্ট্রীয় বাহিনীকে আর জনতার মুখোমুখি করবেন না। পাকিস্তানিরাও সেটা পারেনি। বিভেদ সৃষ্টির খেলাও জিতবে না। ধর্মের নামে, মতবাদের নামে, মুক্তিযুদ্ধের নামে বিভাজনের ফাঁদ অস্বীকার করে বাংলাদেশ ক্রমশ এক হচ্ছে। সেখানে আধুনিক ও রক্ষণশীল, নারী ও পুরুষ, গ্রাম ও শহর, ধনী ও গরিব সব একাকার। জাতীয় ঐক্যের এই সুবর্ণ সুযোগটাকে কাজে লাগাতে এখনই ভুল স্বীকার করে প্রতিকারে নামা দরকার। কারণ, ‘বাংলাদেশ বনপোড়া হরিণীর মতো আর্তনাদ করছে।’
ফারুক ওয়াসিফ: লেখক; সমকালের পরিকল্পনা সম্পাদক
- বিষয় :
- ফারুক ওয়াসিফ
- কোটা সংস্কার আন্দোলন