ঢাকা শনিবার, ১৮ জানুয়ারি ২০২৫

মিয়ানমার

আরাকান আর্মির মংডু দখল বনাম রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন

আরাকান আর্মির মংডু দখল বনাম রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন

ফাইল ছবি

মাহফুজুর রহমান মানিক

প্রকাশ: ১৩ ডিসেম্বর ২০২৪ | ২৩:৫৯

মিয়ানমারে ২০২১ সালে সামরিক অভ্যুত্থানের পর থেকেই দেশটির নাগরিকরা জান্তার বিরুদ্ধে আন্দোলন করে আসছে। একই সঙ্গে সেখানকার বিভিন্ন এলাকার বিদ্রোহী গোষ্ঠীও লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। ফলস্বরূপ, বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর কাছে মিয়ানমার সামরিক জান্তা ইতোমধ্যে বিভিন্ন শহরের নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে। সেই শহরগুলোর মধ্যে চীন ও থাই সীমান্তের গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলো যেমন আছে, তেমনি আছে বাংলাদেশ–লাগোয়া রাখাইনের বহু শহর। সর্বশেষ রাখাইনের মংডু শহর দখলের মাধ্যমে অন্যতম বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মি এখন মিয়ানমারের পুরো পশ্চিম সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ করছে। মংডু যেহেতু বাংলাদেশের সীমান্তঘেঁষা, আমাদের জন্য বিশেষ সতর্কতার কারণ রয়েছে। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে স্পষ্ট, আরাকান আর্মি মংডুর নিয়ন্ত্রণ নেওয়ায় দুই দিক থেকেই বাংলাদেশের নিরাপত্তা ঝুঁকি বেড়েছে। রাখাইনে এখনও পাঁচ লাখের মতো রোহিঙ্গা আছে, যাদের অধিকাংশ মংডুতে বসবাস করে। তাদের সঙ্গে আরাকান আর্মির বিরোধের কারণে রোহিঙ্গাদের পুনরায় বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে। ঠিক এ কারণেই রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনও অনিশ্চয়তায় পড়েছে। 

আমরা দেখেছি, বাংলাদেশের পক্ষ থেকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য মিয়ানমারের জান্তা সরকারের সঙ্গেও আলাপ করা হয়েছিল। এ নিয়ে দু’পক্ষের মধ্যে চুক্তিও আছে। এখন রাখাইনে আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণ বেড়ে যাওয়ায় সামরিক জান্তা ইচ্ছা করলেও সেই চুক্তি কার্যকর করতে পারবে না। তার মানে, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য আরাকান আর্মির সঙ্গেই আলোচনা করা দরকার। তা ছাড়া বাংলাদেশ-মিয়ানমার ২৭০ কিলোমিটার সীমান্তের পুরোটাই আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে থাকার কারণে এ গোষ্ঠীর সঙ্গে যোগাযোগ জরুরি হয়ে পড়েছে। ইতোমধ্যে মংডু দখলের পরই আরাকান আর্মি নাফ নদে নৌ চলাচলে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। যে কারণে টেকনাফের সঙ্গে সেন্টমার্টিনের যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। পর্যটক যারা সেন্টমার্টিন যাচ্ছেন, তারা বিকল্প পথ গ্রহণে বাধ্য হচ্ছেন। 
তবে একটা স্বস্তি হলো, এর আগে মংডু দখল নিয়ে আরাকান আর্মির সঙ্গে মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর লড়াইয়ের কারণে নাফ নদের ওপার থেকে যে গোলা ও গুলি এপারে আসত, সেটা বন্ধ হয়েছে। এই গোলাগুলির কারণে আগে এপারে মানুষ হতাহতও হয়েছে। তখনও টেকনাফের সঙ্গে সেন্টমার্টিনের যোগাযোগ কিছু সময়ের জন্য বন্ধ ছিল। 

বস্তুত আরাকান আর্মি কয়েক মাস ধরেই রাখাইনসহ মিয়ানমারের পশ্চিম সীমান্ত দখল নেওয়ার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। আগে যখন কয়েকটি শহর এই গোষ্ঠী নিয়ন্ত্রণে নিতে সক্ষম হয় তখনই কেউ কেউ বলছিলেন, বাংলাদেশের উচিত আরাকান আর্মির সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করা। কারণ রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে এখন তারা যুক্ত হয়ে পড়েছে। মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের পাঠাতে চাইলে কেবল তাদের আদি নিবাস রাখাইনেই পাঠাতে হবে। তা ছাড়া আমরা যখন নিরাপদ প্রত্যাবাসনের কথা বলছি; রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বসহ নানাবিধ অধিকারের কথা বলছি; রাখাইন ছাড়া সেটা কোথাও সম্ভব নয়। সেই রাখাইনের নিয়ন্ত্রণ যাদের হাতে থাকবে, বাংলাদেশের উচিত তাদের সঙ্গেই সংলাপ করা। মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে প্রতিবেশী হিসেবে ভালো সম্পর্ক রাখতেই হবে। কিন্তু রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান যেহেতু আমাদের অগ্রাধিকার, সেহেতু রাখাইনে আমাদের দৃষ্টি দিতে হবে।

স্থানীয় প্রশাসন সেখানে নিরাপত্তা টহল জোরদার করেছে। নিরাপত্তার জন্য সীমান্তবর্তী এলাকায় মাছ শিকার সাময়িকভাবে বন্ধ রাখা হয়েছে। সীমান্তে অনুপ্রবেশ ঠেকাতে বিজিবি ও কোস্টগার্ডের টহল শক্তিশালী করা হয়েছে। প্রশ্ন হলো, কেবল টহল জোরদার করেই কি এ সমস্যার সমাধান সম্ভব? একদিকে রোহিঙ্গা সমস্যা অন্যদিকে সীমান্তের নিরাপত্তা– দুটি বিষয়ই বাংলাদেশের জন্য জরুরি। এ দুটি বিষয়ে স্বস্তি আনতে বাংলাদেশকে আরাকান আর্মির সঙ্গে যোগাযোগে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত। 
মংডুর পুরো নিয়ন্ত্রণ এমন সময়ে আরাকান আর্মির হাতে চলে গেছে, যখন বাংলাদেশের প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে সম্পর্কে এক ধরনের টানাপোড়েন চলছে। এ অবস্থায় অপর প্রতিবেশী মিয়ানমার সীমান্তের অস্থিরতা আমাদের জন্য দ্বিগুণ মাথাব্যথার কারণ। যে কারণে নিরাপত্তা সতর্কতা জোরদারের বিকল্প নেই। একই সঙ্গে আরাকান আর্মির সঙ্গেও আলোচনার সুযোগ তৈরি করতে হবে। পাশাপাশি রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকাতে কূটনৈতিক তৎপরতা বাড়ানো এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বার্তা দেওয়া জরুরি। নাফ নদে নৌ চলাচল বন্ধ থাকলে তাতে আমাদের জেলে এবং সেন্টমার্টিনের অধিবাসীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সেন্টমার্টিনকেন্দ্রিক পর্যটনেও এর প্রভাব পড়বে। 

মিয়ানমার সামরিক জান্তা একদিকে বিভিন্ন এলাকায় নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে, অন্যদিকে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত থেকেও তাদের ওপর চাপ বাড়ছে। সে কারণেই রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান ও মিয়ানমার সীমান্তে উত্তেজনা কমাতে বাংলাদেশকে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়ার ক্ষেত্রে আরাকান আর্মিকে গুরুত্ব দেওয়ার বিকল্প নেই। সরাসরি সরকারের পক্ষ থেকে না হয়ে তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে হলেও আরাকান আর্মির সঙ্গে সংলাপ চালানো জরুরি হয়ে পড়েছে।

মাহফুজুর রহমান মানিক: জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক, সমকাল
mahfuz.manik@gmail.com
 

আরও পড়ুন

×