ঢাকা বৃহস্পতিবার, ১৬ জানুয়ারি ২০২৫

‘আমার পুরো জীবনটাই সংগ্রামের’

‘আমার পুরো জীবনটাই সংগ্রামের’

রিকতা আখতার বানু

ফরিদুল ইসলাম নির্জন

প্রকাশ: ০৭ ডিসেম্বর ২০২৪ | ২৩:৩১

বিবিসি জরিপে বিশ্বে সেরা ১০০ প্রভাবশালী নারীর মধ্যে বাংলাদেশের একমাত্র নারী হিসেবে রিকতা আখতার বানু জায়গা করে নিয়েছেন। উত্তরবঙ্গের প্রত্যন্ত অঞ্চল কুড়িগ্রামের চিলমারীতে জন্ম। পেশায় নার্স রিকতা সেখানে অটিস্টিক শিশুদের জন্য গড়ে তুলেছেন বিদ্যালয়। তাঁর সঙ্গে কথা বলে লিখেছেন ফরিদুল ইসলাম নির্জন

শৈশব ও কৈশোর
জীবন যেন মোহনার মতো। কখনও থমকে যায়, কখনও নদীর স্রোতের সঙ্গে কচুরিপানার মতো ভেসে বেড়ায়। কখনও বেদনার হাতছানিতে জীবন থামিয়ে দিতে চায়। বেদনার উপস্থিতিতে সবার জীবন কি থামিয়ে দিতে পারে? সবাইকে কি চাইলেই দমিয়ে দেওয়া যায়? না, সেটি সম্ভব নয়। তা দেখিয়ে দিয়েছেন তেমনি একজন নারী– তাঁর নাম রিকতা আখতার বানু। তিনি উত্তরবঙ্গের প্রত্যন্ত অঞ্চলের কুড়িগ্রামের চিলমারীর একজন নারী। কাজের মাধ্যমে নিজের নাম ছড়িয়ে দিয়েছেন পুরো পৃথিবীর বুকে। শৈশব ও কৈশোর কেটেছে কুড়িগ্রামে। এসএসসি ও এইচএসসি পাস করার পর ইচ্ছে জাগে সেবার মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ। পরে কুড়িগ্রাম, রংপুরের নার্সিং ইনস্টিটিউট থেকে পড়াশোনা শেষ করেন। কর্মজীবনে প্রবেশ করলেও পরবর্তী সময়ে তিনি অতীশ দীপংকর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স করেন। পেশাগত কারণে বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে তাঁর ওঠাবসা। এক ছেলে, এক মেয়ের ছোট পরিবার। মেয়েটি প্রকৃতগতভাবে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন মানুষ হিসেবে জন্মগ্রহণ করে। প্রথম পর্যায়ে এটি পরিবার ভালোভাবে মেনে নিলেও, সমাজ তা মেনে নিতে পারেনি। মেয়েটিকে নিয়ে সমাজের প্রতিটি জায়গায় প্রকটভাবে সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। এ ব্যাপারে রিকতা আখতার বানু বলেন, ‘আমার মেয়ে জন্মগ্রহণ করে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশু হিসেবে। এটিতে তো আমার হাত নেই। এটি মহান আল্লাহ পাকের সব ইচ্ছে। কিন্তু তা নিয়ে আমাকে চরমভাবে হয়রানি হতে হয়। এক পর্যায়ে মানসিকভাবে ভেঙে পড়ি। কখনও মনে হয়েছে দুনিয়ায় আমার কোনো জায়গা নেই। মেয়েকে নিয়ে আত্মহত্যা করে মারা যাই। আবার মনে করি, আমি আত্মহত্যা করে মারা গেলে তো সমাধান হবে না। আমার মেয়ের মতো এ দুনিয়ায় আরও অনেক মেয়ে আছে। তারাও আত্মহত্যা করে মারা যাবে। তার চেয়ে নিজে বেঁচে থাকার পাশাপাশি, সমাজে এসব শিশু ও তার পরিবারকে কীভাবে বাঁচিয়ে রাখা যায় সেটি নিয়ে ভাবতে হবে। তারপর হাসপাতালে চাকরি করি।’
স্কুল শুরুর গল্প
মেয়েকে নিয়ে স্কুলে যান। সেখানে ভর্তি করতে চান না। সব শিক্ষক বরং উল্টো কথা শুনিয়ে দেন। অন্য শিক্ষার্থীদের সতর্ক করে দেন, কেউ যেন তাঁর মেয়েকে নিয়ে স্কুলে না প্রবেশ করেন। এই অবহেলা নিজের ভেতর পুড়ে যাচ্ছিল।
হাসপাতালে চাকরি করতেন, আরও অনেক শিশুর এমন দৃশ্য দেখতেন। তখন যেন তাঁর বেদনাগুলো নতুন করে জেগে ওঠত। সেসব শিশুর পরিবারকে সান্ত্বনা দিতেন। বিভিন্নভাবে পরামর্শ দিতেন। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, “আমার মেয়েকে যখন স্কুলে ভর্তি করায় না, আমার খারাপ লাগে। আবার এদিকে হাসপাতালে এমন বাচ্চাদের দেখে তাদের প্রতিও সহানুভূতি জাগে। তখন আমার ভেতরে একটি জেদ কাজ করে। যেভাবেই হোক কিছু একটা করা দরকার। এরপর আমার স্বামীকে এসে বলি, আমার জীবনে তুমি অনেক কিছুই দিয়েছ। আর কিছু চাওয়ার নেই। তবে একটা অনুরোধ– আমি একটি স্কুল খুলতে চাই। বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন সন্তানদের জন্য। এরপর আমার স্বামী চাষ করা জমি স্কুলের জন্য দিয়ে দেন। কিন্তু স্কুল খুলতে তো সরঞ্জামের দরকার। তা পাব কীভাবে। পরে বাবার বাড়ি থেকে যা জমি পেতাম, সেটি বিক্রি করে শুরু করি পথচলা। ২০০৯ সালে গড়ে তুলি ‘রিকতা আখতার বানু (লুৎফা) বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী বিদ্যালয়’ নামে স্কুল। শুরুতে বাচ্চাদের খেলাধুলা, তথ্যপ্রযুক্তির বিভিন্ন কাজ, কারিগরি শিক্ষা দান, কেউ সেলাই, ফুটবল খেলা, স্বাস্থ্যসেবায় নিয়োজিত, নিয়মিত বিভিন্ন বিষয়ে পাঠদান, তাদের ব্যক্তিগতভাবে স্বাস্থ্যসেবা প্রদান।”
স্কুলে শিক্ষক ও শিক্ষার্থী সংগ্রহ
হাসপাতালে চাকরি করার সুবাদে অনেকের সঙ্গে আগে থেকেই যোগাযোগ ছিল। বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুর ঠিকানা সংগ্রহ করতেন এবং সেসব পরিবারের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন। তাদের উৎসাহ দিতেন। তাদের এমন স্কুলের কথা বলতেই রাজি হয়ে যান। শুরুতে ১৬ শিক্ষার্থী নিয়ে যাত্রা শুরু করেন। বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী ফাউন্ডেশনে তাঁর মেয়েকে নিয়ে যেতেন চিকিৎসার জন্য। সেখানে তিনি কোর্স করেন। তারপর সেসব অভিজ্ঞতা বাচ্চাদের জন্য কাজে লাগাতেন। প্রথমে শিক্ষক হিসেবে নিজে কাজ করতেন, পরবর্তী সময়ে আরও অনেকে যুক্ত হন। রিকতা আখতার বলেন, ‘অনেক পরিবার আছে, এমন বাচ্চা জন্ম দেওয়ার জন্য তালাক পর্যন্ত দিতে চাইত। আমি সেই বাচ্চার বাবাকে চাকরি দিয়েছি। আল্লাহপাক সেই বাচ্চার উছিলায় তাদের রিজিকের ব্যবস্থা করেছেন। বর্তমানে স্কুলে ২০ জন শিক্ষক ও প্রায় ৩০০ জন শিক্ষার্থী রয়েছে।’
স্বপ্ন, বাস্তবতা এবং সমাধান
এখনও অনেক স্বপ্ন দেখেন রিকতা। তবে বাস্তবতার কাছে হেরে যান। সে সম্পর্কে তিনি জানান, ‘আমার স্বপ্ন– দেশের সব বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন সন্তানের পাশে থাকা। বাস্তবতা হলো, সামর্থ্য নেই। সেই অনেক আগে বাচ্চাদের আনা-নেওয়ার জন্য ভ্যানগাড়ি কিনেছিলাম। তার দুটো অকেজো হয়ে আছে। মাত্র একটি গাড়িতে যাতায়াত করতে হয়। কম্পিউটার অকেজো হওয়ার পথে। এলাকার অনেক মানুষ আছেন, যারা খেটে খাওয়া মানুষ। তাদের সন্তানদের বাড়িতে রেখেই চলে যান। অনেক সময় অবহেলিত হয়ে থাকে। সারাদিন কী খায় সেভাবে যত্ন নিতে পারছেন না। তাছাড়া অনেকেই সন্তানদের লুকিয়ে রাখেন। আবাসন ব্যবস্থা থাকলে আমরা যত্ন নিতে পারতাম। তারা আমাদের কাছে রেখে নির্বিঘ্নে কাজ করতে পারতেন। সেই সামর্থ্য নেই। রাষ্ট্রীয়ভাবে যদি এ ব্যবস্থা করা হতো, তাহলে আমাদের এলাকার অনেক মানুষ দারুণভাবে উপকৃত হতো এবং এসব সন্তান নিরাপদে থাকতে পারত।’
এই স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর ছেলেমেয়েরা বিভিন্ন খেলা শিখেছে। বাজার বা দোকানে গিয়ে টাকা দিয়ে জিনিস কিনে আবার ফেরত নিয়ে আসতে পারছে। রিকতা বলেন, ‘আমার তো বয়স শেষের পথে। তরুণরা এসব হাল ধরুক। সমাজে আরও এমন প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠুক। এই প্রতিষ্ঠান আবাসিক হলে দূর থেকেও অনেক ছেলেমেয়ে ভর্তি হতে পারবে। ফিজিওথেরাপির জন্য সরঞ্জাম, জগিংয়ের সরঞ্জাম, ভ্যানের ব্যবস্থা, সপ্তাহে এক দিন ডাক্তারি চিকিৎসার ব্যবস্থার ক্ষেত্রে সরকার বা বিত্তবানদের পাশে থাকার অনুরোধ করছি। এটা আমার জন্য নয়, বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশু আর তার প্রতিষ্ঠানের জন্য।’ v

আরও পড়ুন

×