বিশ্বজুড়ে কোটি মানুষের জীবন বদলে দেওয়ার কারিগর ছিলেন স্যার ফজলে হাসান আবেদ। বাংলাদেশের প্রত্যেক মানুষের সঙ্গে সংযোগ ছিল তার। তার অবদান ভুলে গেলে, তা হবে বাংলাদেশকে ভুলে যাওয়া। বন্ধু ফজলে হাসান আবেদের জীবন ও কর্মকে এভাবেই স্মরণ করেন শান্তিতে নোবেল জয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস।

গত ২০ ডিসেম্বর মহাসিন্ধুর ওপারে পাড়ি জমান পৃথিবীর সবচেয়ে বড় এনজিও ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা স্যার ফজলে হাসান আবেদ। মঙ্গলবার রাজধানীর বসুন্ধরা আন্তর্জাতিক কনভেনশন সেন্টারে তার স্মরণে অনুষ্ঠিত হয় 'সেলিব্রেটিং দ্য লাইফ অ্যান্ড লিগ্যাসি অব স্যার ফজলে হাসান আবেদ'। ব্র্যাকের নিম্নপদস্থ কর্মী থেকে শুরু করে সুধীজন সবাই স্মরণ করেছেন স্যার আবেদকে।

ব্র্যাকের এ আয়োজনে উপস্থিত ছিলেন দেশ-বিদেশের সমাজচিন্তক, রাজনীতিক, কূটনীতিক, উন্নয়নকর্মী, শিক্ষাবিদ, অর্থনীতিবিদ, গবেষক, গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব, সংস্কৃতিসেবীসহ বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার বিশিষ্ট ব্যক্তিরা। এতে ব্র্যাক গ্লোবাল বোর্ডের চেয়ারপারসন আমিরা হক জানান, টানা পঞ্চমবারের মতো বিশ্বসেরা এনজিওর স্বীকৃতি পেয়েছে স্যার আবেদের হাতে গড়া প্রতিষ্ঠান ব্র্যাক।

স্যার আবেদের কর্মময় জীবনের তথ্যচিত্র প্রদর্শনীর মধ্য দিয়ে শুরু হয় তাকে স্মরণ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতার লাইন 'জীবনেরে কে রাখিতে পারে/ আকাশের প্রতি-তারা ডাকিছে তাহারে' খুব প্রিয় ছিল তার। প্রিয় কবিতাতেই স্যার আবেদকে স্মরণ করেন সাবেক সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। মুক্তিযুদ্ধের পর বিধ্বস্ত দেশ গড়ে তুলতে ব্র্যাক প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ফজলে হাসান আবেদ। তার আগে সত্তরের ঘূর্ণিঝড়ে দুর্গতদের পাশে দাঁড়ান। প্রতিষ্ঠানকে ছাড়িয়ে যান তিনি। ৮৩ বছরের জীবনে অসংখ্য দেশি ও আন্তর্জাতিক পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছেন। বাংলাদেশ ছাড়িয়ে আফ্রিকার দরিদ্র দেশের মানুষের জীবনমান উন্নয়নেও তিনি কাজ করেন। তার ব্র্যাক কাজ করে আফগানিস্তানে। জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসও স্মরণ করেছেন স্যার আবেদকে। তার বার্তা পড়ে শোনান জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়ক মিয়া সেপ্পো।

ফজলে হাসান আবেদের স্মরণে স্মৃতিকথা তুলে ধরেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ্‌ চৌধুরী, হার্ভার্ড কেনেডি স্কুলের শিক্ষক ড. মার্থা চেন, ফজলে হাসান আবেদের মেয়ে তামারা আবেদ, ছেলে শামেরান আবেদ, ব্র্যাক স্কুলের শিক্ষিকা মাজেদা খানম।

স্মরণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন, সংবিধানের অন্যতম প্রণেতা ড. কামাল হোসেন, সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, সাবেক মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন এমপি, সাবেক মন্ত্রী ড. আবদুল মঈন খান, অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহান, সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরী, সাবেক উপদেষ্টা ও ব্র্যাকের চেয়ারপারসন অধ্যাপক ড. হোসেন জিল্লুর রহমান, বাংলাদেশে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত রবার্ট আর্ল মিলার, অস্ট্রেলিয়ান হাইকমিশনের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স পেনি মর্টন, ডিএফআইডির বাংলাদেশ প্রধান জুডিথ হার্বার্টসন, অধ্যাপক মো. ইব্রাহিম, অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত, নিজেরা করি'র নির্বাহী পরিচালক খুশী কবির প্রমুখ।

ড. ইউনূস বলেন, বিশ্বজুড়ে এনজিও সম্পর্কে প্রচলিত ধারণাকেই পাল্টে দিয়েছেন তার বন্ধু আবেদ। এক দিনের আলোচনা সভা, একটি-দুটি বই প্রকাশ করে সম্পূর্ণ আবেদকে তুলে ধরা যাবে না। এর জন্য প্রতিষ্ঠান প্রয়োজন। তাকে জানতে পারলে বাংলাদেশকে জানা যাবে। ড. ইউনূস আরও বলেন, ফজলে হাসান আবেদ শুধু নিজে প্রতিষ্ঠিত নন। তার সঙ্গে যারা কাজ করেছেন, তারাও প্রতিষ্ঠিত। তাদের প্রতিষ্ঠিত এনজিওগুলো শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নারীর ক্ষমতায়নে কী অসাধারণ কাজ করছে! ফজলে হাসান আবেদের নামে কিডনি প্রতিস্থাপন সেন্টার স্থাপনের ঘোষণা দেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ্‌ চৌধুরী। তিনি জানান, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র যে কিডনি ডায়ালাইসিস সেন্টার স্থাপন করছে তাতে ১০ কোটি টাকা অনুদান দিয়েছিলেন ফজলে হাসান আবেদ।

গণসাক্ষরতা অভিযানের প্রধান নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশে শিক্ষা বিস্তারে কাজ করা এনজিওগুলোর মোর্চা গঠনের কাজটি ফজলে হাসান আবেদই করেছিলেন। গঠন করেছিলেন গণসাক্ষরতা অভিযান।

ব্র্যাকের জ্যেষ্ঠ পরিচালক শামেরান আবেদ বলেন, তার বাবা এমন এক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন, যেখানে গাড়িচালক-অফিস সহকারী থেকে কর্মকর্তা পর্যন্ত যে কারও সমস্যার কথাই তিনি মনোযোগ দিয়ে শুনতেন। তার দরজা ছিল সবার জন্যে উন্মুক্ত।

ব্র্যাকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তামারা আবেদ তার বাবার জীবনের শেষ দিনগুলোর কথা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, মস্তিস্কের টিউমারে জীবনের অন্তিম সময়ে উপনীত হয়েছেন জেনেও ফজলে হাসান আবেদ ধীরস্থির ও সংকল্পবদ্ধ ছিলেন। যুক্তরাজ্য থেকে দেশে ফিরে ব্র্যাকের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করেন। অনুষ্ঠানের ফাঁকে ফাঁকে স্যার ফজলে হাসান আবেদের জীবনকে তুলে ধরা হয় ছবিতে। তার প্রিয় রবীন্দ্রসংগীত গেয়ে শোনান অদিতি মহসিন এবং শামা রহমান। সবশেষে আগতদের ধন্যবাদ জানিয়ে স্যার আবেদের স্বপ্নকে সফল করার প্রত্যয় ব্যক্ত করে শপথ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সমাপ্তি ঘোষণা করেন ব্র্যাক গ্লোবাল বোর্ডের চেয়ারপারসন আমিরা হক।