রেকর্ড ত্রাণকর্মী নিহতের বছর
ইসরায়েলি বিমান হামলায় নিহত ত্রাণকর্মীদের স্মরণে শোক প্রকাশ করেন সাধারণ মানুষ, পোল্যান্ড, ৪ এপ্রিল ২০২৪/ রয়টার্স
শাহেরীন আরাফাত
প্রকাশ: ১৩ ডিসেম্বর ২০২৪ | ২৩:২৪ | আপডেট: ১৪ ডিসেম্বর ২০২৪ | ০৬:৫৪
ইসরায়েলি আগ্রাসনের কারণে ভয়াবহ মানবিক সংকট সৃষ্টি হয়েছে ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায়। হামলায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে এই উন্মুক্ত কারাগার। গাজার বেসামরিক নাগরিকদের পাশাপাশি লাশের মিছিল দীর্ঘ হয়েছে ওই অঞ্চলে কাজ করা ত্রাণ ও মানবাধিকারকর্মীর। এ বছর নভেম্বর পর্যন্ত গাজাসহ বিভিন্ন দেশে অন্তত ২৮১ জন নিহত হয়েছেন। লিখেছেন শাহেরীন আরাফাত
অন্য যেকোনো বছরের তুলনায় ২০২৪ সালে বেশি ত্রাণকর্মী নিহত হয়েছেন। এইড ওয়ার্কার সিকিউরিটি ডেটাবেস (এডব্লিউডিএস) থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে ২৮০ জন ত্রাণকর্মী নিহত হওয়া ছিল আগের রেকর্ড। এ বছর নভেম্বরে সেই রেকর্ড ভেঙে ১৯টি দেশে অন্তত ২৮১ জন ত্রাণকর্মী নিহত হয়েছেন।
নিহত ত্রাণকর্মীর প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ বা ১৭৮ জনই নিহত হয়েছেন ফিলিস্তিনে। ইসরায়েলের গাজায় ১৭৫ জন এবং অধিকৃত পশ্চিম তীরে তিনজনকে হত্যা করা হয়েছে। জাতিসংঘের মতে, ৭ অক্টোবর ২০২৩ থেকে গাজায় অন্তত ৩৩৩ জন ত্রাণকর্মী ইসরায়েলি হামলায় নিহত হয়েছেন।
ত্রাণকর্মীদের সাহায্য কর্মী বা মানবিক কর্মীও বলা হয়। সংঘাত, প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা দারিদ্র্যের মতো সংকটে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের মধ্যে জীবন রক্ষাকারী সহায়তা প্রদান করেন এ ত্রাণকর্মীরা। তারা খাদ্য বিতরণ করেন, আশ্রয় দেন, চিকিৎসাসেবা প্রদান করেন, বিশুদ্ধ পানি ও স্যানিটেশনের ব্যবস্থা করেন এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় সংকট ব্যবস্থাপনা সেবা প্রদান করেন। মানবিককর্মীরা সাধারণত ইউএন এজেন্সি, ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব রেড ক্রস ও রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটিস, সেই সঙ্গে আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় বেসরকারি সংস্থাসহ (এনজিও) অলাভজনক সংস্থাগুলোর সঙ্গে কাজ করে।
গাজায় বেশির ভাগ ত্রাণকর্মী জাতিসংঘের রিলিফ অ্যান্ড ওয়ার্কস এজেন্সি ফর প্যালেস্টাইন রিফিউজিস ইন দ্য নিয়ার ইস্টের (ইউএনআরডব্লিউএ) সঙ্গে সম্পর্কিত। ৭ অক্টোবর থেকে প্রতিষ্ঠানটির ১৩ হাজার কর্মী-সদস্যের মধ্যে অন্তত ২৪৩ জন নিহত হয়েছেন। প্রতি ৫০ জন কর্মীর মধ্যে একজন। জাতিসংঘের ইতিহাসে এটি সর্বোচ্চ কর্মী মৃত্যুর সংখ্যা।
ফিলিস্তিনের বাইরে এ বছর অন্তত ১০৩ জন ত্রাণকর্মী নিহত হয়েছেন, যার মধ্যে ২৫ জন সুদানে, ১১ জন ইউক্রেনে এবং ১১ জন কঙ্গোতে।
জাতিসংঘের মানবিক সাহায্য সংস্থা ওসিএইচএ-এর মুখপাত্র জেনস লার্কে সাংবাদিকদের নিহত ত্রাণকর্মীদের সম্পর্কে বলেন, ‘তারা মানবতার সর্বোত্তম পর্যায়ের কাজে নিয়োজিত ছিলেন। এর বিপরীতে তাদের রেকর্ড সংখ্যায় হত্যা করা হচ্ছে।’
জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি-জেনারেল এবং জরুরি ত্রাণ সমন্বয়কারী টম ফ্লেচার বলেন, ‘এই সহিংসতা অযৌক্তিক এবং ত্রাণ কার্যক্রমের জন্য ধ্বংসাত্মক। সংঘাতে জড়িত রাষ্ট্র এবং পক্ষগুলোকে অবশ্যই মানবতাবাদীদের রক্ষা করতে হবে, আন্তর্জাতিক আইন সমুন্নত রাখতে হবে, দায়ীদের বিচার করতে হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘নিহতের অধিকাংশই স্থানীয় কর্মী, তাদের মধ্যে ১৩ জন আন্তর্জাতিক ত্রাণকর্মী রয়েছেন।’
ত্রাণকর্মীরা আন্তর্জাতিক মানবিক আইনের অধীনে সুরক্ষা ভোগ করেন। তবে বিশেষজ্ঞরা এ ধরনের মামলা বিচারের জন্য কয়েকটি নজির উল্লেখ করে বলেছেন, দাতাগোষ্ঠীগুলোর জন্য ভবিষ্যতে কাজের পরিধি নিশ্চিত করার বিষয়ে উদ্বেগ এবং বাধার সৃষ্টি হবে।
ত্রাণকর্মীদের ভয়াবহভাবে হত্যা করা হচ্ছে। তাদের সাহস এবং মানবতাকে বুলেট-বোমা দিয়ে আঘাত করা হচ্ছে। গাজা যুদ্ধে হতাহতের সংখ্যা বেড়েছে। একইভাবে ত্রাণকর্মীদেরও হত্যাযজ্ঞের লক্ষ্য করা হয়েছে।
এইড ওয়ার্কার সিকিউরিটি ডেটাবেসের তথ্য অনুসারে, শুধু নভেম্বরে গাজাতেই ১০ স্থানীয় ত্রাণকর্মী নিহত হয়েছেন। এই সংখ্যাগুলো নিঃসন্দেহে মানবিক সম্প্রদায়ের চারপাশে শকওয়েভের কাজ করছে। বিশ্বব্যাপী ত্রাণকর্মী হত্যার সমালোচনা হচ্ছে। তবে সংঘাতও বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ছে। এর ফলে ত্রাণকর্মীদের গাজা ছাড়াও অন্যান্য জায়গায় বিপদের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। গাজা ছাড়াও সুদান, লেবানন, ইউক্রেন এবং অন্যান্য সংঘাতপূর্ণ জায়গায় সাহসিকতার সঙ্গে এবং নিঃস্বার্থভাবে কাজ করছেন ত্রাণকর্মীরা। আফগানিস্তান, কঙ্গো, দক্ষিণ সুদান, সুদান, ইউক্রেন এবং ইয়েমেনে ব্যাপক সহিংসতা, অপহরণ, হামলা, হয়রানি এবং নির্বিচার আটকের মুখে পড়তে হচ্ছে ত্রাণকর্মীদের। ২০২২ সালের তুলনায় ২০২৩ সালে ৭২ শতাংশ বেশি বেসামরিক মানুষ নিহত হয়েছেন।
চ্যালেঞ্জ এবং বিপদ সত্ত্বেও মানবিক সংস্থাগুলো অত্যাবশ্যক সহায়তা দিয়ে চলেছে। গত বছর প্রায় ১৪৪ মিলিয়ন মানুষের কাছে ত্রাণ পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। এই সংকটের প্রতিক্রিয়া হিসেবে, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ রেজলিউশন ২৭৩০ (২০২৪) গৃহীত হয়েছে, যা মহাসচিবকে ত্রাণকর্মীদের ওপর আক্রমণ প্রতিরোধ এবং মানবিক সাহায্য প্রদানকারীদের সুরক্ষা বাড়ানোর জন্য ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করে। এ সুপারিশগুলো ২৬ নভেম্বর নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকে উপস্থাপন করা হয়।
তখন মানবিক ও ত্রাণকর্মীদের বিরুদ্ধে সহিংসতার স্বাভাবিকীকরণের বিরুদ্ধে সতর্কতা জানিয়ে ইকুয়েডরের প্রতিনিধি রাষ্ট্রগুলোকে পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা এবং তথ্য সংগ্রহ ব্যবস্থা উন্নত করতে এবং তথ্য বিনিময় ও পরিষেবা সহায়তার জন্য প্রক্রিয়াগুলো শক্তিশালী করার আহ্বান জানিয়েছেন। ত্রাণকর্মীদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তার জন্য আহ্বান জানান জাপানের প্রতিনিধি। প্রসংগত, জাপান জাতিসংঘের নিরাপত্তা ও সুরক্ষা প্রকল্প ‘ক্যাপাসিটি বিল্ডিং ইন ক্রাইসিস সাইকোসোশ্যাল সাপোর্ট’-এ বড় আর্থিক অবদান রাখছে। সংঘাতপূর্ণ এলাকায় গুরুতর সহিংসতা, অপহরণ, আঘাত, হয়রানি এবং নির্বিচারে আটকের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে আন্তর্জাতিক মানবতাবাদী ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং কমিশনের কাজকে শক্তিশালী করার আহ্বান জানানো হয়েছে।
- বিষয় :
- ত্রাণ বিতরণ
- স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন
- নিহত