ন্যায়বিচার পাওয়া বড় চ্যালেঞ্জ
নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতারোধে আইন থাকা সত্ত্বেও সংশ্লিষ্টদের কার্যকর ভূমিকার অভাব রয়েছে
সাজিদা ইসলাম পারুল
প্রকাশ: ০৭ ডিসেম্বর ২০২৪ | ২৩:২৬
ঝালকাঠির নলছিটিতে নতুন ঘর তৈরির কথা বলে প্রবাসী স্ত্রীর (নাছিমা) কাছ থেকে ৬ লাখ টাকা নেন মো. রানা। এরপর আবারও টাকা চাইলে নাছিমা তা দিতে অস্বীকার করেন। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে চলতি বছরের ১১ মে রানা ও তাঁর পরিবারের লোকজন মিলে রাত ১০টা থেকে নাছিমাকে বেধড়ক মারধর শুরু করেন। ভোর ৪টা পর্যন্ত তাঁকে ঘরে আটকে নির্যাতন করা হয়। এ সময় ফ্রিজে বরফ জমানো পানির বোতল দিয়ে তাঁর মেরুদণ্ডে আঘাত করা হয়।
শুধু যৌতুক নয়, এ বছরের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত অর্থাৎ প্রথম ১১ মাস বাল্যবিয়ে, ধর্ষণ, গৃহকর্মী নির্যাতন ও হত্যার ঘটনা ঘটে অন্যান্য বছরের তুলনায় বেশি। চলতি বছরের ২০ অক্টোবর ১৩ বছর বয়সী কল্পনা বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার একটি বাসায় দিনাত জাহান নামের এক তরুণীর বাসায় নির্যাতনের শিকার হয়। সাড়ে চার বছর ধরে ওই বাসায় সে কাজ করত। নির্যাতনের শিকার হয়ে তাকে বার্ন ইউনিটের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) ভর্তি হতে হয়। নির্যাতনে তার সামনের চারটি দাঁত ভেঙে গেছে। বুক, পিঠসহ সারা শরীরে ছ্যাঁকা ও মারধরের ক্ষত।
এ বছর নির্যাতনের শিকার হন দুই হাজার ৩৬২ জন নারী ও কন্যাশিশু। তাদের মধ্যে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৩৩০ জন নারী ও কন্যাশিশু। ১৭২ জন নারী যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছেন। যৌতুকের কারণে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৩০ জন এবং একই কারণে হত্যা করা হয়েছে ২৯ জন নারীকে। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের কেন্দ্রীয় লিগ্যাল এইড উপ-পরিষদে সংরক্ষিত ১৬টি জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে নারী ও কন্যা নির্যাতনের এ তথ্য জানা যায়। মানবাধিকার কর্মীদের মতে, সমাজে নারীরা প্রতিনিয়ত পারিবারিক সহিংসতার শিকার হচ্ছেন। বাংলাদেশে পারিবারিক নির্যাতনের ঘটনা একটি দীর্ঘস্থায়ী সামাজিক সমস্যায় পরিণত হয়েছে। পারিবারিক নির্যাতনের শিকার একজন নারীর ন্যায়বিচার ঘরের চার দেয়ালের মধ্যে সীমাবদ্ধ, যা নারীর সমঅধিকার প্রতিষ্ঠায় এক প্রকার বৈষম্য সৃষ্টি করে। এদিকে নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে সরকারি-বেসরকারি যৌথ কার্যক্রম থাকলেও ন্যায়বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে বহুমুখী চ্যালেঞ্জ বিদ্যমান রয়েছে।
নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতারোধে দেশে কঠোর আইন থাকা সত্ত্বেও অপরাধ দমন ও নিয়ন্ত্রণে সংশ্লিষ্টদের কার্যকর ভূমিকার অভাব রয়েছে। মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের (এমএসএফ) তথ্য অনুযায়ী, নভেম্বর মাসে ৩২০টি নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা সংঘটিত হয়েছে; যা অক্টোবরের তুলনায় ৩২টির বেশি। এ মাসে ধর্ষণের ঘটনা ২৯টি, সংঘবদ্ধ ধর্ষণ ৭টি, ধর্ষণ ও হত্যা ২টি। এর মধ্যে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৫ জন প্রতিবন্ধী শিশু ও কিশোরী।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সুরাইয়া পারভীন বলেন, ‘নারী নির্যাতন প্রতিরোধে আইন থাকা সত্ত্বেও এর সঠিক বাস্তবায়নের অভাবে অপরাধীরা পার পেয়ে যায়। ফলে সঠিক বিচার না হওয়ায় তারা পুনরায় নারী নির্যাতন, যৌন হয়রানি, ধর্ষণের মতো কাজে লিপ্ত হতে ভয় পায় না। এ ছাড়া নারী নির্যাতনের পেছনে আরও একটি কারণ হলো, সামাজিক চাপ ও নারীর সামাজিক মর্যাদা ক্ষুণ্ন হওয়ার ভয়।’
‘আমরাই পারি’ পারিবারিক নির্যাতন প্রতিরোধ জোটের প্রধান নির্বাহী জিনাত আরা হক সমকালকে বলেন, ‘ন্যায়বিচার প্রাপ্তি সহিংসতার শিকার নারী ও কন্যাশিশুর মৌলিক মানবাধিকার। সহজে অভিযোগ গ্রহণ, কার্যকর হটলাইন সেবা, জেন্ডার সংবেদনশীল পুলিশ প্রশাসন, মামলার ত্রুটিমুক্ত তদন্ত, দক্ষ ও দায়বদ্ধ প্রসিকিউশন টিম, মামলার দ্রুত বিচার, অভিযুক্ত ব্যক্তিকে কোনোরকম বিবেচনায় ছাড় না দিয়ে দ্রুত বিচারের আওতায় নিয়ে আসা, সহিংসতার শিকার নারী ও কন্যাশিশুকে সব পর্যায়ে নিরাপত্তা দেওয়া, নিরাপদ আশ্রয়কেন্দ্রে রাখার ব্যবস্থাসহ সাক্ষী সুরক্ষার ব্যবস্থা করা ন্যায়বিচার প্রাপ্তির অন্যতম শর্ত। তবে অনেক ক্ষেত্রে অভিযোগের শুরুতেই সহিংসতার শিকার নারী ও কন্যাশিশুকে নানা প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে হয়। মামলা কীভাবে করবে, কে সহায়তা করবে, সে বিষয়ে সহিংসতার শিকার নারী ও সাধারণ মানুষ জ্ঞাত নয়। থানা কর্মকর্তাদের অনেকের জেন্ডার সংবেদনশীলতার অভাব পরিলক্ষিত হয়। থানায় নারী ডেস্ক থাকলেও প্রাথমিক অভিযোগ নেওয়ার ক্ষেত্রে নানা ধরনের চ্যালেঞ্জ দেখা যায়। মামলার তদন্তে দুর্বলতার জন্য অনেক মামলায় আসামিরা ছাড়া পেয়ে যায়। আসলে বাংলাদেশে ভুক্তভোগী নারীকে প্রমাণ করতে হয় যে অপরাধের শিকার।’ v
- বিষয় :
- ন্যায়বিচার